বাচ্চাদের দাঁত ওঠার লক্ষণ

বাচ্চাদের দাঁত ওঠা বাবা-মায়েদের জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা, একই সাথে কিছুটা চ্যালেঞ্জিংও বটে! আপনার ছোট্ট সোনামণির প্রথম দাঁত ওঠার মুহূর্তটা যেমন আনন্দের, তেমনি এই সময়টায় ওদের কিছু কষ্টও হয়। দাঁত ওঠা মানেই যে শুধু নতুন দাঁত বের হওয়া, তা কিন্তু নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে ওদের শারীরিক ও মানসিক কিছু পরিবর্তন। এই লেখাটা আপনাদের জন্যই, যারা এই সময়টাতে আপনার বাচ্চার পাশে থাকতে চান এবং দাঁত ওঠার লক্ষণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান।

দাঁত ওঠা কী এবং কখন শুরু হয়?

সাধারণত, ৬ মাস বয়স থেকে বাচ্চাদের দাঁত ওঠা শুরু হয়, তবে এটা একেক বাচ্চার ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে ৪ মাসেই শুরু হতে পারে, আবার কেউ কেউ এক বছর বয়সেও প্রথম দাঁতের দেখা পায়। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক! দাঁত ওঠার এই প্রক্রিয়াটা বেশ লম্বা, প্রায় ২-৩ বছর পর্যন্ত চলতে পারে, যতক্ষণ না ওদের সব দুধ দাঁত (মোট ২০টা) উঠে আসে।

বাচ্চাদের দাঁত ওঠার লক্ষণ: কী দেখে বুঝবেন?

দাঁত ওঠার সময় বাচ্চাদের মধ্যে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা যায়। এগুলো দেখে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে আপনার সোনামণির দাঁত উঠছে। চলুন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ জেনে নিই:

১. লালা ঝরা বা অতিরিক্ত থুতু পড়া

দাঁত ওঠার সময় বাচ্চাদের মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা ঝরতে দেখা যায়। এটা এতটাই বেশি হতে পারে যে ওদের জামাকাপড় ভিজে যেতে পারে। এই লালা ঝরার কারণ হলো, নতুন দাঁত বের হওয়ার সময় মাড়িতে অস্বস্তি হয় এবং শরীর তখন লালা উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়।

২. মাড়ি ফোলা ও লালচে হওয়া

দাঁত যখন মাড়ির ভেতর থেকে বের হতে শুরু করে, তখন মাড়ি ফুলে যায় এবং লালচে দেখায়। অনেক সময় মাড়ির সেই অংশে ছোট একটা সাদা বিন্দুও দেখা যেতে পারে, যা আসলে দাঁতের অগ্রভাগ।

৩. খিটখিটে মেজাজ ও কান্নাকাটি

দাঁত ওঠার ব্যথা বাচ্চাদের জন্য বেশ কষ্টকর হতে পারে। এই ব্যথার কারণে ওরা খিটখিটে হয়ে যায়, সারাক্ষণ কান্নাকাটি করতে পারে এবং কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। রাতের বেলায় এই সমস্যা আরও বাড়তে পারে, কারণ তখন অন্য কোনো কিছুতে ওদের মনোযোগ থাকে না।

৪. যেকোনো কিছু কামড়ানো বা চিবানো

মাড়িতে চুলকানি এবং অস্বস্তি কমানোর জন্য বাচ্চারা হাতের কাছে যা পায়, তাই মুখে দিতে চায় এবং কামড়াতে থাকে। খেলনা, আঙুল, এমনকি আপনার আঙুলও ওরা কামড়ে ধরতে পারে! এটা ওদের মাড়ির চুলকানি কমানোর একটা প্রাকৃতিক উপায়।

Enhanced Content Image

৫. ঘুমের ব্যাঘাত

ব্যথা এবং অস্বস্তির কারণে বাচ্চাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ওরা ঘুমানোর সময় বারবার জেগে উঠতে পারে, কান্নাকাটি করতে পারে এবং ঘুম থেকে উঠলে অস্থির থাকতে পারে।

৬. খাবারে অনীহা

দাঁত ওঠার ব্যথার কারণে অনেক বাচ্চা খেতে চায় না। বিশেষ করে শক্ত খাবার খেতে ওদের অসুবিধা হতে পারে। এই সময়টায় ওদের নরম খাবার দেওয়া ভালো।

৭. হালকা জ্বর

কিছু বাচ্চার দাঁত ওঠার সময় হালকা জ্বর আসতে পারে। তবে মনে রাখবেন, যদি জ্বর ১০১° ফারেনহাইট (৩৮.৩° সেলসিয়াস) এর বেশি হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। দাঁত ওঠার কারণে উচ্চ জ্বর হয় না, তাই উচ্চ জ্বর হলে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে।

৮. ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা

Enhanced Content Image

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দাঁত ওঠার সময় বাচ্চাদের হজমে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে, যার ফলে হালকা ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হতে পারে। তবে এটি খুব বেশি গুরুতর হলে বা দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

দাঁত ওঠার সময় আপনার করণীয়

আপনার বাচ্চার কষ্ট কমাতে আপনি কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন:

  • টিথার (Teether) ব্যবহার করান: ঠাণ্ডা টিথার মাড়ির ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। রেফ্রিজারেটরে রাখা টিথার (ফ্রিজারে নয়) বাচ্চাকে চিবানোর জন্য দিন।
  • মাড়ি ম্যাসাজ করুন: পরিষ্কার আঙুল দিয়ে আলতো করে বাচ্চার মাড়ি ম্যাসাজ করে দিন। এতে ব্যথা কমতে পারে।
  • নরম খাবার দিন: এই সময়টায় বাচ্চাকে নরম, ঠাণ্ডা খাবার যেমন- দই, ফলের পিউরি, ঠাণ্ডা স্যুপ দিতে পারেন।
  • ব্যথানাশক ঔষধ: যদি ব্যথা খুব বেশি হয় এবং বাচ্চা খুব অস্থির থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন (শিশুদের জন্য উপযোগী) দেওয়া যেতে পারে। তবে নিজে নিজে কোনো ঔষধ দেবেন না।
  • লালা পরিষ্কার রাখুন: অতিরিক্ত লালা ঝরার কারণে বাচ্চার মুখ, চিবুক ও গলা ভিজে যেতে পারে, যা র‍্যাশের কারণ হতে পারে। নিয়মিত নরম কাপড় দিয়ে লালা মুছে শুকনো রাখুন।

দাঁত ওঠার সময়কাল: কোন দাঁত কখন ওঠে?

বাচ্চাদের দাঁত ওঠার একটা নির্দিষ্ট ক্রম আছে, যদিও এটা সব বাচ্চার ক্ষেত্রে একই রকম নাও হতে পারে। নিচে একটি সম্ভাব্য ক্রম দেওয়া হলো:

দাঁতের ধরন সম্ভাব্য বয়স (মাস)
ইনসিসর (সামনের দাঁত) ৬-১০
ল্যাটারাল ইনসিসর (সামনের পাশের দাঁত) ৯-১৩
প্রথম মোলার (পেছনের দাঁত) ১৩-১৯
ক্যানাইন (ছেদন দাঁত) ১৬-২২
দ্বিতীয় মোলার (পেছনের শেষ দাঁত) ২৩-৩৩

Enhanced Content Image

দ্রষ্টব্য: এই সময়কালগুলো আনুমানিক। আপনার বাচ্চার দাঁত উঠতে এর থেকে কম বা বেশি সময় লাগতে পারে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

প্রশ্ন ১: দাঁত ওঠার সময় কি বাচ্চাদের জ্বর হওয়া স্বাভাবিক?

উত্তর: দাঁত ওঠার সময় বাচ্চাদের হালকা জ্বর (১০১° ফারেনহাইট বা ৩৮.৩° সেলসিয়াস এর নিচে) হতে পারে। তবে যদি জ্বর এর বেশি হয় বা অন্য কোনো লক্ষণ যেমন কাশি, সর্দি, বা বমি থাকে, তাহলে সেটা দাঁত ওঠার কারণে নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দাঁত ওঠা সরাসরি উচ্চ জ্বরের কারণ নয়।

প্রশ্ন ২: আমার বাচ্চা দাঁত ওঠার সময় কিছুই খেতে চাইছে না, কী করব?

উত্তর: দাঁত ওঠার ব্যথার কারণে অনেক বাচ্চা খেতে অনীহা প্রকাশ করে। এই সময়টায় ওদের নরম, ঠাণ্ডা খাবার যেমন- দই, ফলের পিউরি, ঠাণ্ডা স্যুপ, বা নরম ভাত দিতে পারেন। জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না। অল্প অল্প করে বারবার অফার করুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন ৩: দাঁত ওঠার সময় কি বাচ্চাদের ডায়রিয়া হয়?

উত্তর: কিছু বাচ্চার দাঁত ওঠার সময় হালকা পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া হতে পারে। এর কারণ হলো, এই সময়টায় ওরা সবকিছু মুখে দেয়, যার ফলে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। এছাড়াও, অতিরিক্ত লালা গিলে ফেলার কারণেও হজমে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। তবে যদি ডায়রিয়া গুরুতর হয়, পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা যায় বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

প্রশ্ন ৪: দাঁত ওঠার সময় বাচ্চার মাড়িতে রক্ত দেখা গেলে কি চিন্তার কিছু আছে?

উত্তর: সাধারণত দাঁত ওঠার সময় মাড়ি থেকে রক্তপাত হয় না। তবে দাঁত যখন মাড়ি ভেদ করে বের হয়, তখন খুব সামান্য রক্ত দেখা যেতে পারে, যা স্বাভাবিক। যদি বেশি রক্তপাত হয় বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বন্ধ না হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন ৫: দাঁত ওঠার সময় কি বাচ্চার দাঁতের যত্ন নেওয়া শুরু করতে হবে?

উত্তর: হ্যাঁ, প্রথম দাঁত ওঠার পর থেকেই দাঁতের যত্ন নেওয়া শুরু করা উচিত। নরম ভেজা কাপড় বা আঙুল দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করুন। এক বছর বয়সের পর থেকে বাচ্চাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি নরম ব্রাশ ও সামান্য পেস্ট (ফ্লোরাইডবিহীন বা খুব কম ফ্লোরাইডযুক্ত) ব্যবহার করা যেতে পারে। নিয়মিত দাঁতের যত্ন ভবিষ্যতে সুস্থ দাঁতের ভিত্তি তৈরি করে।

প্রশ্ন ৬: আমার বাচ্চার দাঁত দেরিতে উঠছে, এটা কি স্বাভাবিক?

উত্তর: হ্যাঁ, বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সময় একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে। কারো কারো ৪ মাস বয়সে দাঁত ওঠা শুরু হয়, আবার কারো ১০-১২ মাস বয়সেও প্রথম দাঁত দেখা যায়। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। যদি আপনার বাচ্চার ১ বছর বয়সের পরও কোনো দাঁত না ওঠে, তাহলে একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।

প্রশ্ন ৭: দাঁত ওঠার সময় টিথার কীভাবে ব্যবহার করব?

উত্তর: টিথার বাচ্চার মাড়ির ব্যথা কমাতে খুব কার্যকর। টিথার রেফ্রিজারেটরে (ফ্রিজারে নয়) রেখে ঠাণ্ডা করুন। ঠাণ্ডা টিথার বাচ্চার মাড়িতে আরাম দেবে। নিশ্চিত করুন যে টিথার পরিষ্কার এবং বাচ্চার জন্য নিরাপদ উপাদান দিয়ে তৈরি।

শেষ কথা

আপনার ছোট্ট সোনামণির দাঁত ওঠা এক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এই সময়টায় ওদের একটু বাড়তি যত্ন আর মনোযোগ দরকার হয়। লক্ষণগুলো সম্পর্কে জেনে রাখলে আপনি ওদের কষ্ট কিছুটা হলেও কমাতে পারবেন এবং এই নতুন ধাপটা ভালোভাবে পার করতে পারবেন। মনে রাখবেন, প্রতিটি শিশুই আলাদা, তাই আপনার বাচ্চার লক্ষণগুলো একটু ভিন্ন হতে পারে। কোনো রকম অস্বাভাবিক কিছু দেখলে বা আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জাগলে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার বাচ্চার সুস্থ ও সুন্দর দাঁত ওঠার যাত্রায় আপনার প্রচেষ্টা অবশ্যই সফল হবে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top