আপনি কি কখনও ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হেঁটেছেন আর ভেবেছেন, এই শহরের শুরুটা হয়েছিল কীভাবে? কে এই বিশাল মহানগরীর স্বপ্ন দেখেছিলেন? ঢাকা, আমাদের প্রিয় এই শহরের গোড়াপত্তন নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও, ইতিহাস ঘাঁটলে কিছু নির্দিষ্ট নাম আর ঘটনা আমাদের সামনে চলে আসে। আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমরা ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠাতার খোঁজে এক মজার যাত্রায় বের হবো। চলুন, আপনার সাথে আমিও এই রহস্যের জট খুলি!
ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন: ইতিহাসের পাতা থেকে
ঢাকা শহরকে নিয়ে যখনই কথা ওঠে, তখন এর প্রাচীনত্ব আর সমৃদ্ধির গল্পগুলোও চলে আসে। কিন্তু এর প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্পটা ঠিক কী? ঢাকা কি একদিনে তৈরি হয়েছিল, নাকি এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের বিবর্তন?
ঢাকার নামকরণ ও প্রাথমিক ইতিহাস
ঢাকার নামকরণের পেছনে বেশ কিছু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, এটি 'ঢাকা' নামক এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র থেকে এসেছে। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন, 'ধাকেশ্বরী' দেবীর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই নামকরণের চেয়েও ঢাকার প্রাচীন জনবসতির প্রমাণ অনেক পুরোনো। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দিকেই এই অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু তখনও এটি আজকের মতো একটি শহর হয়ে ওঠেনি।
প্রধান স্থপতি কে ছিলেন?
যখন আমরা "ঢাকা শহর প্রতিষ্ঠা করেন কে" এই প্রশ্ন করি, তখন আসলে একজন একক ব্যক্তির নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ ঢাকা আধুনিক অর্থে একটি শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে ধাপে ধাপে, বিভিন্ন শাসকের হাত ধরে। তবে কিছু নাম এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে:
-
ইসলাম খান চিশতী: ১৬১০ সালে সুবাহদার ইসলাম খান চিশতী ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন এবং এর নামকরণ করেন 'জাহাঙ্গীরনগর' বাদশাহ জাহাঙ্গীরের নামে। অনেকেই তাকে ঢাকার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করেন, কারণ তার হাতেই ঢাকা একটি প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হতে শুরু করে। তিনি দুর্গ, মসজিদ, প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদি নির্মাণ করে শহরটিকে নতুন রূপ দেন। বলা যায়, তিনি ঢাকার আধুনিক যুগের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
-
মুঘল শাসকরা: ইসলাম খান চিশতীর পর অন্যান্য মুঘল সুবাহদাররাও ঢাকার উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। মীর জুমলা, শায়েস্তা খান, মুর্শিদকুলি খান — এঁরা প্রত্যেকেই ঢাকার অবকাঠামো ও স্থাপত্যে নিজেদের ছাপ রেখে গেছেন। লালবাগ কেল্লা, হোসনি দালান, বিভিন্ন মসজিদ ও সেতু—এসবই মুঘলদের অবদান।
-
বারো ভুঁইয়ারা: মুঘলদের আগমনের আগে এই অঞ্চল বারো ভুঁইয়াদের অধীনে ছিল, যাদের মধ্যে ঈশা খাঁ ছিলেন অন্যতম প্রভাবশালী। যদিও তারা ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেননি, তবে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়াতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
তাহলে, এককভাবে কাউকে ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা বলাটা একটু কঠিন। তবে যদি আধুনিক ঢাকার ভিত্তি স্থাপনের কথা বলা হয়, তাহলে সুবাহদার ইসলাম খান চিশতীর নামই সবার আগে চলে আসে।
ঢাকার বিবর্তন: একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ঢাকা শহর প্রতিষ্ঠার গল্পটা শুধু একজন মানুষের গল্প নয়, এটি সময়ের সাথে সাথে এর বিবর্তনের গল্পও বটে।
মুঘল আমল: স্বর্ণযুগ
মুঘল আমলে ঢাকা তার স্বর্ণযুগ দেখেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য – সবদিক থেকেই ঢাকা হয়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ নগরী। সুদূর ইউরোপ থেকে বণিকরা এখানে আসতেন ব্যবসা করতে। এখানকার মসলিন ছিল বিশ্বখ্যাত। মুঘল সুবাহদাররা বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে শহরকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলেন। শহরের চারপাশে খাল খনন করা হয়, যা যোগাযোগ ও বাণিজ্যে সহায়তা করেছিল।
ব্রিটিশ আমল: পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণ
মুঘলদের পর ব্রিটিশরা যখন বাংলায় আসে, ঢাকার গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। তবে ব্রিটিশরাও শহরটির উন্নয়নে কিছু কাজ করে। রেলপথ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আধুনিক রাস্তাঘাট – এসবের সূত্রপাত হয় ব্রিটিশ আমলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কার্জন হল, হাইকোর্ট ভবন – এসবই ব্রিটিশ স্থাপত্যের দারুণ উদাহরণ। এই সময়েই ঢাকা ধীরে ধীরে একটি আধুনিক শহরের রূপ নিতে শুরু করে।
পাকিস্তান আমল ও স্বাধীনতা পরবর্তী ঢাকা
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হয়। এই সময়ে শহরে নতুন করে গতি আসে। এরপর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ঢাকা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। তখন থেকেই ঢাকা দ্রুত গতিতে প্রসারিত হতে থাকে এবং আজকের এই বিশাল জনাকীর্ণ মহানগরীতে পরিণত হয়।
ঢাকার প্রতিষ্ঠাতাদের অবদান: একটি সংক্ষিপ্ত সারণী
শাসক/গোষ্ঠী | অবদান | সময়কাল |
---|---|---|
ইসলাম খান চিশতী | ঢাকার রাজধানী স্থাপন, নামকরণ 'জাহাঙ্গীরনগর', প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিকাশ, দুর্গ ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ। | ১৬১০ খ্রিস্টাব্দ |
অন্যান্য মুঘল সুবাহদার | লালবাগ কেল্লা, হোসনি দালান, বিভিন্ন মসজিদ, সেতু নির্মাণ, শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। | ১৬১০-১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ |
বারো ভুঁইয়ারা | মুঘলদের আগমনের পূর্বে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন। | ষোড়শ শতাব্দী |
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী | আধুনিক রাস্তাঘাট, রেলপথ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ। | ১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ |
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকার | স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দ্রুত নগরায়ন, আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে বিকাশ। | ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান |
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. ঢাকা শহরের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে?
ঢাকা শহরের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এককভাবে কাউকে চিহ্নিত করা কঠিন। তবে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে সুবাহদার ইসলাম খান চিশতী যখন ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করেন এবং এর নামকরণ করেন 'জাহাঙ্গীরনগর', তখন থেকেই ঢাকা একটি সুসংগঠিত শহর হিসেবে বিকশিত হতে শুরু করে। তাই অনেকেই তাকে আধুনিক ঢাকার ভিত্তি স্থাপনকারী হিসেবে গণ্য করেন।
২. ঢাকার পুরোনো নাম কী ছিল?
ঢাকা যখন বাংলার রাজধানী ছিল, তখন এর নাম ছিল 'জাহাঙ্গীরনগর'। এটি মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে নামকরণ করা হয়েছিল।
৩. ঢাকা কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
১৬১০ খ্রিস্টাব্দে সুবাহদার ইসলাম খান চিশতী ঢাকাকে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে এর আগেও এই অঞ্চলে জনবসতি ছিল, কিন্তু ১৬১০ সাল থেকে এটি একটি প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৪. ঢাকার নামকরণের পেছনে কী কারণ রয়েছে?
ঢাকার নামকরণের পেছনে বেশ কিছু মত প্রচলিত আছে। একটি মত অনুযায়ী, 'ঢাকা' নামক এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র থেকে এর নামকরণ হয়েছে। আরেকটি জনপ্রিয় বিশ্বাস হলো, ধাকেশ্বরী দেবীর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে।
৫. মুঘল আমলে ঢাকার গুরুত্ব কেমন ছিল?
মুঘল আমলে ঢাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর ছিল। এটি ছিল বাংলার রাজধানী এবং একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। এখানকার মসলিন বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত ছিল এবং বিভিন্ন দেশ থেকে বণিকরা এখানে ব্যবসা করতে আসতেন।
৬. ঢাকার প্রাচীনতম নিদর্শন কোনটি?
ঢাকার প্রাচীনতম নিদর্শনের মধ্যে ধাকেশ্বরী মন্দির অন্যতম। এটি ঢাকার নামকরণ ও প্রাচীনত্বের সাথে জড়িত। এছাড়াও, লালবাগ কেল্লা, হোসনি দালান, সাত গম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি মুঘল আমলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন।
৭. ইসলাম খান চিশতী কেন ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন?
ইসলাম খান চিশতী কৌশলগত কারণে ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর কাছাকাছি হওয়ায় এটি যোগাযোগ ও বাণিজ্যের জন্য সুবিধাজনক ছিল। এছাড়াও, এখান থেকে বারো ভুঁইয়াদের দমন করা সহজ ছিল।
৮. ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নিদর্শনগুলো কী কী?
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, কার্জন হল, সাত গম্বুজ মসজিদ, ধাকেশ্বরী মন্দির এবং বিভিন্ন পুরোনো জমিদার বাড়ি ও মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
৯. ঢাকার জনসংখ্যা কখন থেকে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে?
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ার পর থেকে এর জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হলে এই বৃদ্ধির হার আরও ত্বরান্বিত হয়।
১০. ঢাকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব কী?
ঢাকা বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। এখানে দেশের প্রধান বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অবস্থিত। এটি দেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু।
এই যে আমরা এক দারুণ যাত্রায় বের হয়েছিলাম, তাই না? ঢাকা শহর প্রতিষ্ঠা করেন কে, এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা দেখলাম, একজন একক ব্যক্তি নন, বরং যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন শাসক ও তাদের অবদানেই আমাদের এই প্রিয় শহর গড়ে উঠেছে। সুবাহদার ইসলাম খান চিশতী থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ঢাকা, এর প্রতিটি ইট-পাথরে মিশে আছে হাজারো গল্প আর ইতিহাস। এই শহর আমাদের গর্ব, আমাদের পরিচয়।
আপনি কি ঢাকার কোনো পুরোনো গল্প জানেন? অথবা এই শহর সম্পর্কে আপনার কোনো বিশেষ স্মৃতি আছে? নিচে কমেন্ট করে আমাদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার মতামত আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান!